“নাসির! বাবা এদিকে আয়।” ভোরের কাক ডেঁকে ওঠার আগেই, বৃদ্ধা ডাকলেন তাঁর ছেলেকে। বললেন, রাইতে অশৈদ খাওয়ার পর মাথা ধরা আরো বাড়লোরে’ এই মাথাধরাই আমারে খাইবো রে নাসির”। নাসির মাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করে, “ আর দুই একবার খাইলেই সাইরে যাইবো মা! তুমি তহন সুস্থ হইয়া যাইবা।” বৃদ্ধা নাসিরের শেষ কথাটি শুনতে পারেন না ব্যথার জ্বালায়, অচেতন হয়ে পড়েন। নাসির মায়ের মাথায় হাত বুলাতে থাকে। একা একা কী যেন বলে, বোঝা যায় না। তবে ওর অশ্রুর ভাষাটা বোঝা যায়। শোকে-দু:খে মানুষ যখন ভাষা হারিয়ে ফেলে, তখন চোখের অশ্রুই মুখের ভাষা হয়ে কথা বলে, নাসিরের অশ্রুও তার না বলা কথাগুলো বলে দিচ্ছিল- এর বিশাল বাড়ি-গাড়ি- এসব দিয়ে আর কী হবে (?) মা যদি চলে যান, আমি একা কী করবো। রাতে কোথায় থাকবো, বিপদে কার আশ্রয় নেবো। বাড়ি-গাড়ি কি আশ্রয় দিতে পারে মানুষকে। কষ্ট ঘুচাতে পারে মানুষের! মুমূর্ষ মায়ের িএকমাত্র সন্তানের ভাষা এমনই হয়ে থাকে। নাসিরের অশ্রু সে কথাই বলছিল।
চারদিক ফরসা হয়ে এসেছে। আযান পড়েছে অনেকক্ষণ আগে। নামায পড়ে নাসির আবার বসেছে মায়ের শয্যার পাশে। এখনো মায়ের চেতন আসেনি। এরই মধ্যে একবার ডাক্তার এসে দেখে যায়। নাসিরকে জানায় রোগ মোটামুটি ভালই আছে। এখন ঘুমুচ্ছে। দুই-একের মধ্যে আরো উন্নতির আশা করছি। নাসির আশ্বস্ত হয়। কিছুক্ষণ পর মা জেগে ওঠেন, বলেন, বাবা! আমি সুস্থ হইলে, তুই আমারে সিলেট নিয়া যাবি। আমি শাহজালালের মাজারে যামু, শাহপরানের মাজারে যামু। মায়ের কথায় নাসির খুশী হয়। বলে, মা আল্লায় তোমারে ভালো কইরা দিবো। “ আমরা অবশ্যই সিলেট যামু।”
মা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। নাসিরও আগের মত নিয়মিত অফিসে যায়, ব্যবসা দেখে। মা-ছেলের ক্ষুদ্র সংসার আবার সজীব হয়ে ওঠে। এরমধ্যে একদিন তারা সিলেটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে। নাসির নিজেই দক্ষ চালক। তাই ইচ্ছা করেই সেদিন কোন ড্রাইভার নেয়নি। অনেকদিন পর তারা এমন অন্তরঙ্গ ও স্বাভাবিক পরিবেশ পেয়েছে। মা তাঁর অতীতের কথা ছেলেকে শোনাচ্ছেন- তোর বাপে আর আমি একবার নৌকায় বেড়াইতে বাইরাইছিলাম। তুই তহনো দুনিয়ায় আসস নাই। আসবার প্রস্তুতি নিবার লাগছিলি- হ্যায় নিজেই ইস্পিরিট বোট চালাইবার লাগছিল। কত যে আনন্দ লাগছিল তহন! কিন্তু হেই আনন্দ হ্যার সইলো না। কেমনে জানি, বোটটা একটা টলারের সাথে লাইগ্যে গেল। তিনি চইলা গেলেন আমাকে আধমরা অবস্থায় নদী থেইকে উঠান হইলো। হ্যার দু:খ সইব্যার জন্যে। আইজ যদি তোর বাপ থাকতো কতই না আনন্দ পাইত।” কথা বলতে বলতে বৃদ্ধার কণ্ঠ জড়িয়ে আসে। আঁসুতে চোখ ভরে যায়। জানালা দিয়ে আসা বাতাসে অশ্রু শুকিয়ে যায়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মা আবার বলতে শুরু করেন- বাবা! তুই কি জানস- আইজ আমরা মাজারে কেন যাইতেছি?
: জানি, মা। তোমার মান্নত পুরা করার জন্য।
: না বাবা, যাইতেছি, ঘরে বউ আনার জন্য দোয়া করতে। কী হয় তা তো কওয়া যায় না। তাছাড়া তোরও তো বয়স কম হয় নাই! নাসির কিছু বলে না। মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে দৃষ্টি অবনত করে ফেলে। দুপুরের দিতে ওরা শাহজালালের মাজারে পৌঁছে। যোহর পড়ে উভয়েই মান্নত পুরা করে। মায়ের সুস্থতার জন্যে এবং ঘর আলো-করা বধুর জন্যে দোয়া করে। এরপর যায় শাহপরানের মাজারে সেখানেও প্রার্থনা করে। তখন বিকেল প্রায় হয়ে এসেছে। নাসির মাকে বলে, মা! চলো না আমরা একবার ঝর্ণা দেখে আসি। তোমার মাথা ধরা একটু হইলেও হয়ত কমবো। এরপর তারা মাধবকুণ্ডের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে। ঝর্ণার কিনারে যখন পৌঁছে। তখন সন্ধ্যার আয়োজন চলছে। মুখোমুখি দু’টি পাথরে ওরা বসে। বরফগলা শীতল পানি পরম যত্নে ওদের পা ধুয়ে দেয়। ওরা কথা বলতে থাকে। নাসির হঠাৎ লক্ষ্য করে, মা কেমন যেন টলমল করছে। সে একমুহূর্ত ভারে, মাকে ধরে নিযে যাবে গাড়িতে, নাকি অষুধ এনে খাইয়ে দিবে? মুহূর্তের মধ্যে নাসির ছুটে এসে অষুধ নিয়ে যায় গাড়ি থেকে। কিন্তু ততক্ষণে মায়ের আঁচল গড়িয়ে পড়েছে পানিতে। ঝর্ণার শীতল পানি শীতল করে দিয়েছে ওর মাকে।
0 comments:
Post a Comment